Pray for the world economy

বিবর্তন বনাম স্রষ্টা [Evolution or God]

 

এই মহাবিশ্বের বিস্ময় দেখে আমার এক সময় একজন মহানির্মাতার ছবি মনে আসত। ডারউইনের বিজ্ঞান পড়ার পর, সেই ছবি মন থেকে উধাও হয়ে যায়।

 – রিচার্ড ডকিন্স [1]

 

নাস্তিকতার হাল আমলের গুরু রিচার্ড ডকিন্স। দেশে তাকে নিয়ে অনেকের উচ্চ ধারণা থাকলেও খোদ ব্রিটেনের বিজ্ঞানীদের একাংশ তাকে অপছন্দ করেন। তাঁদের অভিযোগ – ডকিন্স বিকৃত বিজ্ঞান প্রচার করে। (দেখুন টেলিগ্রাফ-এর খবর) ধর্ম নিয়ে যেসকল অভিযোগ তিনি করেন সেগুলো মোটাদাগের ও অনেকাংশেই বিকৃত উপস্থাপন। [2]

 

আমরা অধিকাংশই সেলিব্রেটি কালচারে আক্রান্ত। পূজিত ব্যক্তিজন কিছু বললেই আমরা তা মাথা পেতে নেই, বুঝি বা না-বুঝি। তারপর ভান করি সব বুঝে গেছি। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় নাস্তিকদের তালিকায় প্রফেসর ডকিন্স প্রথমই হবেন হয়তো। মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হওয়া বইয়ের লেখক, অক্সফোর্ডের সাবেক অধ্যাপক কি আর ভুল বলবেন? কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি ভুল বলেছেন। যার দোহাই দিয়ে ভুল বলেছেন সেই ডারউইন সাহেবও তার এই বক্তব্যের সাথে একমত নন! অবাক হচ্ছেন? হওয়ারই কথা।

 

আসুন ডকিন্সের বক্তব্য একটু ব্যবচ্ছেদ করি। ১ম অংশটা খেয়াল করুন – ফিতরাহ-এর অনুভূতির স্বীকারোক্তি স্পষ্ট! মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় দেখে এক মহানির্মাতার অস্তিত্বের অনুভূতির ব্যাপারটা মানুষের মনস্তত্ত্বে গ্রথিত বলা যায়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে পাওয়া পর্যবেক্ষণও তাই জানাচ্ছে। তাছাড়া ডকিন্সের আরেকটি উক্তিতে এই ফিতরাহ-এর অনুভূতির স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়! [3]

 

এবার ২য় অংশে আসি। তিনি বলেছেন – ডারউইনের বিজ্ঞান পড়ার পর সেই মহানির্মাতার ছবি মন থেকে উধাও হয়ে যায়। এই উক্তিটিতেই বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রতীভাত। বিজ্ঞান কাজ শুরু করার আগে কতগুলো অনুমান বা এসাম্পসনকে ঠিক বলে ধরে নেয়। [4]  এগুলোর মাঝে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান অনুমান হলো  Methodological Naturalism বা পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদ। এর অর্থ হলো – আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে সেসব প্রাকৃতিক ঘটনাবলির জাগতিক ব্যাখ্যা দেওয়াই যথেষ্ঠ। বস্তুজগতের বাইরের কিছু বা প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরের কিছুকে কোনও প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যাস্বরূপ টেনে আনা যাবে না। তাই স্রষ্টা আছে না-কি নেই, এই প্রশ্নে বিজ্ঞান নিরব। এটা তার নাগালের বাইরে। আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সাইন্সেস-স্বাক্ষী দিচ্ছে :

 

বিজ্ঞান হলো প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জাগতিক ব্যাখ্যা প্রদানেই এটি সীমাবদ্ধ। অতিপ্রাকৃত কিছু আছে কি না, সে বিষয়ে বিজ্ঞান কিছুই বলতে পারে না। স্রষ্টা আছে কি নেই, এ প্রশ্নের ব্যাপারে বিজ্ঞান নীরব । [5]

 

যেহেতু পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদে বিশ্বাসের কারণে, বিজ্ঞান স্রষ্টাকে সমীকরণের বাইরে রেখে যাত্রা শুরু করে, তাই বৈজ্ঞানিক বিবর্তনতত্ত্বের প্রচেষ্টাও হলো মানুষসহ সকল প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশের জাগতিক ব্যাখ্যা দেওয়া। তাই ডারউইনের বিজ্ঞান পড়ে কেবল তার মন থেকেই স্রষ্টার ধারণা উধাও হতে পারে সে বিজ্ঞানের এসাম্পসান ও কর্মপরিধি সম্পর্কে অজ্ঞ। বিজ্ঞানের যে-কোনও তত্ত্বই স্রষ্টার অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের ব্যাপারে নিরব। নাস্তিক প্রফেসর লরেন্স এম. ক্রউস বলেন:

 

বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে বিবর্তনবাদ স্রষ্টার অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের বিষয়ে কিছুই বলে না। এমনকি প্রাণ কীভাবে উৎপত্তি হল সে বিষয়েও কিছু বলে না বরং কীভাবে পৃথিবীর এত বৈচিত্রময় প্রজাতির আবির্ভাব হল তা নিয়ে আলোচনা করে…” [6]

 

ডারউইনের জীবনী ঘেঁটে পাওয়া যায়, তার তত্ত্ব দিয়ে যারা নাস্তিকতা প্রচার করতো ডারউইন তাদের পছন্দ করতেন না।

 

বিবর্তনবাদি প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা লিখেন:

 

যদিও এই সত্য এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে, বিজ্ঞানের দর্শনের সামনে ধর্মকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো নিরর্থক। ডারউইনের সমসাময়িক প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানীই ছিলেন ধর্মবিশ্বাসী, আস্তিক এবং তাঁরা এই বলে ডারউইনবাদ গ্রহণ করেন যে, ঈশ্বর প্রাণের আদিস্রষ্টা আর বিবর্তন ঘটেছে তাঁরই নির্দেশে, সুতরাং একে স্বীকৃতিদানে ধর্মচ্যুতির [নাস্তিকতার] আশংকা অমূলক। অন্যথা ডারউইনের শিক্ষক হেনশ্লো এবং বন্ধু লায়েল ও হুকার কখনোই তাঁর তত্ত্বের পৃষ্ঠপোষক হতেন না। [7]

 

ডারউইনের জীবনী ঘেঁটে পাওয়া যায়, তার তত্ত্ব দিয়ে যারা নাস্তিকতা প্রচার করতো ডারউইন তাদের পছন্দ করতেন না। তাছাড়া ডারউইন এক চিঠিতে নিজেও বলেছেন –

 

কোন ব্যক্তি একই সাথে বিবর্তনবাদি ও গোড়া আস্তিক হতে পারে। এ নিয়ে কোনও প্রকার সন্দেহ আমার কাছে অবান্তর লাগে।” [8]

 

 

যার তত্ত্ব দিয়ে ডকিন্স নাস্তিকতাবাদ ফেরি করে বেড়াচ্ছেন সেই ডারউইন কি নাস্তিক ছিলেন? উত্তর হচ্ছে, না! জীবনের শেষকালে উনি সংশয়বাদে প্রবেশ করেন। স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করা অর্থে নাস্তিক তিনি ছিলেন না, নিজের মুখেই বলেছেন। তাহলে কেন সংশয় তার ভেতর বাসা বেঁধে নিলো? এর কারণ স্বীয় দর্শনগত অবস্থান, তার তত্ত্বের কারণে তিনি সংশয়বাদি হন নি। [9]  তত্ত্বপ্রদানকারী নিজে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কারনে নাস্তিক হলেন না, অথচ ডকিন্স সাহেব নাস্তিক হয়ে গেলেন। কি অদ্ভূত! আর আমরাও তার সাথে তাল মিলিয়ে নাচছি! তারা আমাদের নিয়ে খেলেন, আমরাও সানন্দে পুতুল হতে রাজি! [10]

 

 

[লেখাটি অবিশ্বাসের বিভ্রাট বই থেকে সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত]

লেখকের নিজস্ব ওয়েবসাইটে লেখাটিঃ https://rafanofficial.wordpress.com/2019/09/16/evolution-or-god/

 

তথ্যসূত্র :

[1] অতনু চক্রবর্তী, রিচার্ড ডকিন্স: ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যিনি লড়ে চলেছেন নিরন্তর! এগিয়ে চলো, ২৭ মার্চ ২০১৮

[2] দেখুন ফোর্বস-এর আর্টিকেল

[3] রাফান আহমেদ, অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়; পৃ. ৫৫-৬৯ (ঢাকা : সমর্পন প্রকাশন, ২য় সংস্করণ এপ্রিল ২০১৯)

[4] Dr. Martin Nickels, The Nature Of Modern Science & Scientific Knowledge. Anthropology Program, Illinois State University, August 1998; Macaulay A. Kenu, The Limitations of Science: A Philosophical Critique of Scientific Method. Journal of Humanities & Social Science, vol. 20, Issue 7, p. 80-81 (July 2015)

[5] HTTPS://WWW.NAP.EDU/READ/5787/CHAPTER/6#58

[6] SCIENCE IN THE DOCK, DISCUSSION WITH NOAM CHOMSKY, LAWRENCE KRAUSS & SEAN M. CARROLL, SCIENCE & TECHNOLOGY NEWS, MARCH 1, 2006

[7] দ্বিজেন শর্মা, চার্লস ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি; ভূমিকা (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ৩য় মুদ্র ২০১৬)

[8] BELIEF IN GOD AND IN EVOLUTION POSSIBLE, DARWIN LETTER SAYS. THE NEW YORK TIMES, 27 DECEMBER 1981

[9] Nick Spencer, Darwin and God (SPCK, January 31, 2009)

[10] মজার ব্যাপার কি জানেন? ডকিন্স এক সাক্ষাতকারে ফস করে বলে ফেলেছেন – বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করলে তাকে নাস্তিক হতে হবে এই চিন্তা ভুল। দ্বিমুখীতা, তাই না? দেখুন: Lawrence Krauss discussion with Richard Dawkins about Education, Universe, and Evolution; Available at: https://youtu.be/WObFAvOw830